Main Menu

মহানবী (সা.) কে অবমাননা: এক কাতারে মুসলিম বিশ্ব, অগ্নিপরীক্ষায় ভারত

বিদেশবার্তা২৪ ডেস্ক:
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়েছে দেশটি। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি বিশ্বের অংশীদারদের শান্ত করার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছে নয়াদিল্লি।

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত মাসে এক টেলিভিশন শোতে অংশ নিয়ে বিতর্কিত ওই মন্তব্য করেছিলেন। পরে দলটির নয়াদিল্লি শাখার গণমাধ্যম প্রধান নবীন জিনদালও নূপুর শর্মার মন্তব্যের সমর্থনে টুইট করেন। তাদের এই মন্তব্য দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের মন্তব্যের জেরে দেশটির কয়েকটি রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন।

বিজেপির এই দুই নেতা প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এবং দল থেকেও শর্মাকে বরখাস্ত ও জিনদালকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

দলটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি যেকোনও ধর্মের, যেকোনও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অবমাননার তীব্র নিন্দা জানায়। কোনও সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান বা হেয় করে, এমন যেকোনও মতাদর্শের বিরুদ্ধেও বিজেপির অবস্থান। বিজেপি এমন মানুষ বা মতাদর্শের প্রচার করে না।

সমালোচকরা বলেছেন, নূপুর শর্মা এবং নবীন জিনদালের মন্তব্য ভারতের গভীর ধর্মীয় মেরুকরণের প্রতিফলন; যা গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে দেখা গেছে। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্য এবং আক্রমণ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আন্তর্জাতিক মোড় নেওয়ার পর বিজেপির প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট নাও হতে পারে। কারণ রোববার কুয়েত, কাতার এবং ইরানসহ কয়েকটি দেশ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছে। সৌদি আরবও সোমবার এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে।

বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ভারতকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে বলে জানিয়েছে কাতার। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘‘এই ধরনের ‘ইসলামভীতিপূর্ণ’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে তা মানবাধিকার রক্ষায় গুরুতর বিপদ তৈরি এবং অত্যধিক কুসংস্কার ও প্রান্তিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যা সহিংসতা ও ঘৃণার চক্র তৈরি করবে।’’

সৌদি আরবও বিবৃতিতে কিছু কড়া শব্দ ব্যবহার করেছে। দেশটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি মুখপাত্রের বক্তব্যে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’ এদিকে, কাতারে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দ্বীপক মিত্তাল বলেছেন, কিছু লোকের মন্তব্য কখনই ভারত সরকারের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতারা এবং অন্যান্য কূটনীতিকরাও বিতর্কিত মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন।

৫৭ মুসলিম দেশের জোট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এবং পাকিস্তানও ভারতের সমালোচনা করেছে। কিন্তু নয়াদিল্লি উভয় দেশের সমালোচনা করে বলেছে, এই ইস্যুতে তাদের মন্তব্য ‘অবাঞ্ছিত এবং সংকীর্ণ মনের’, যা সচরাচর করে আসে তারা।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে হতে পারে। তারা বলছেন, তা না করলে আরব বিশ্ব ও ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই বিতর্ক ভারতের সাম্প্রতিক কিছু সাফল্যকেও ম্লান করে দিতে পারে।

ঝুঁকিতে অনেক কিছু
মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের জোট গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সাথে ভারতের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই জোটের সদস্য কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। লাখ লাখ ভারতীয় এসব দেশে বসবাস এবং কর্মরত রয়েছেন। তারা দেশে লাখ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠান। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চল থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি জ্বালানিও আমদানি করে।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিয়মিত এই অঞ্চল সফর করেছেন। দেশটি ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং একটি বিস্তৃত চুক্তির জন্য জিসিসির সাথে আলোচনা করছে।

২০১৮ সালে আবুধাবিতে প্রথম হিন্দু মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে ঢাকঢোল পিটিয়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় এটিকে ভারত এবং এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। গত কয়েক বছর ধরে তেহরানের সাথে দিল্লির সম্পর্কে উষ্ণতা দেখা গেলেও চলমান বিতর্ক ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের আসন্ন ভারত সফরকে ছাপিয়ে যেতে পারে।

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত মাসে এক টেলিভিশন শোতে অংশ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন
ভারতের সাবেক কূটনীতিক জিতেন্দ্র নাথ মিশ্র বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে এবং সম্পর্কে রূপান্তর ঘটেছে। এছাড়া আরেকটি উজ্জ্বল বিষয় হল ইউক্রেন সংকট মোকাবিলা।’

জিসিসি ও ভারতের জন্যই এই সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উভয় পক্ষই ঝুঁকি কমানোর দিকে নজর রাখবে।

তিনি বলেন, ভারতের স্বার্থ এগিয়ে নেয় না এমন সমস্যা মোকাবিলায় এখন স্বল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে ভারতের বিদেশি অফিসগুলোকে মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে। আমরা কূটনীতিকরা ভারতের বন্ধুত্বের বৃত্ত বাড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং এটি এমন এক ধরনের অগ্নিনির্বাপক; যা আমরা কোনও কিছু ছাড়াই করি।

আরব বিশ্বে কাজ করা ভারতের সাবেক আরেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত বলেছেন, ভারত এক ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। কেবল নেতৃত্ব পর্যায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টাই ভারতের নেতিবাচক পতন রোধ করতে পারে। তিনি বলেন, এই ধরনের লৌকিকতাবর্জিত মন্তব্যের যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও দেশের সুনাম নষ্ট না করে সেজন্য অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অন্যান্য বিশ্লেষকরা বলেছেন, এমন বিবাদের কূটনৈতিক মূল্য এই অঞ্চলে ভারতের স্বার্থকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাসহ বিদেশি রাজধানীগুলো যখন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সমালোচনা করে, তখন ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রায়ই প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া দেখান। তবে এক্ষেত্রে ভারতীয় কূটনীতিকরা ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতি মোকাবিলার অন্যান্য উপায়ের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনে দ্রুত কাজ করবেন বলে আশা করছি।

আরব দেশগুলোও নিজ নাগরিকদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে চাইছে। এসব দেশে ভারতের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হয়েছে। একই সাথে এই ঘটনা তাদের গণমাধ্যমের শীর্ষ খবরে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু হ্যাশট্যাগে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কাতার এবং কুয়েতের কিছু দোকান তাদের তাক থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে নিয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, কৌশলগত সংকটপূর্ণ অঞ্চলের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দিল্লির যতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, ঠিক ততটাই হয়েছে। পাশাপাশি নিজের প্রভাবের মাধ্যমে আরও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ভারত। অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণেই ভারতকে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এছাড়া উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতীয়দের বসবাস ও কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও অব্যোহত রাখতে হবে।

এসব দেশ মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য কতদূর পর্যন্ত যাবে, সেটিরও সীমা থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন এশিয়া সেন্টারের এই উপপরিচালক।

ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ
সমালোচকরা বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ দেশটিতে বিশেষ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। কারণ দেশটির কট্টর হিন্দুত্ববাদী কিছু গোষ্ঠী উত্তর প্রদেশের বারাণসীর স্থানীয় আদালতে শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদে উপাসনার অনুমতি চেয়ে পিটিশন দায়ের করেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা।

দেশটির টেলিভিশন চ্যানেলগুলো উসকানিমূলক বিতর্কের আয়োজন করেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ঘৃণা দেখা গেছে।

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে প্রায়ই টেলিভিশন শোতে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, নূপুর শর্মা মূলধারার রাজনীতিক ছিলেন না। একই দাবি করেছে বিজেপিও। তিনি দলটির একজন মুখপাত্র ছিলেন; যাকে বিজেপির মতামতের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

বিতর্কের বৈশ্বিক ফল ভারতকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার আহ্বান হিসেবে নেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, দেশে যখন ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত রাজনীতি শুরু হয়, তখন এটি আর ভারতে সীমাবদ্ধ থাকে না। দিল্লি এখন সেই শিক্ষা নিচ্ছে। ভারতের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিদেশে এর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হচ্ছে, তখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিদেশে তাদের ঝুঁকি তৈরি করছে।

সূত্র: বিবিসি






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *