Main Menu

‌দুবাই কষ্টের প্রবাস জীবন, রাত কাটে পার্কে বা জনবহুল কক্ষে

বিদেশবার্তা২৪ ডেস্ক:
চারপাশে আকাশছোঁয়া ভবন, দূরে চোখে পড়ে বুর্জ আল খলিফার ঝাঁ চকচকে চূড়া। রাত হলেই ঝলমলিয়ে ওঠে সব। আর সেই আলোর ঝলকানির নিচেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নতুন অন্ধকার। দুবাইয়ের পার্ক ও স্টেশনে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে দেখা গেলো শত শত মানুষকে। যাদের মধ্যে বাংলাদেশিই বেশি। ভিজিট ভিসায় কাজের সন্ধানে এসে পড়েছেন বিপদে। আধপেটা খেয়েই শুয়ে থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।

এভাবে অবাধে বাংলাদেশিরা আমিরাতে এসে ক্ষুণ্ন করছেন দেশের ভাবমূর্তি। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছেন প্রবাসীদেরও। এছাড়া যারা বৈধভাবে আছেন তাদেরও বেশিরভাগ বসবাসের জায়গা জনাকীর্ণ এবং অস্বাস্থ্যকর।

একসময় কাজের জন্য বিদেশযাত্রা মানেই ছিল দুবাই গমন। ‘টাকা দাও, দুবাই যামু’ সংলাপ এখনও জনপ্রিয়। কিন্তু সেই দুবাই-স্বপ্ন এখন অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনার কারণে দেশটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল দীর্ঘদিন। এমনকি বাংলাদেশিদের জন্য নতুন করে ওয়ার্ক পারমিটও ছিল বন্ধ। তারপরও দুবাই-আবুধাবি যাওয়া থামেনি।

 

দুবাই প্রবাসী সাংবাদিক কামরুল হাসান জনি জানালেন, বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য সরাসরি ভিসা আরব আমিরাত দেয় না। তবে কেউ এখানে ভিজিট ভিসায় আসার পর যদি কাজ জোটাতে পারেন, তখন ওয়ার্ক পারমিট ভিসার আবেদন করা যায়। অনেকে এভাবে ভিজিট ভিসায় এসে কাজ খুঁজে পেয়েছেন, ভিসাও পেয়েছেন।

কামরুল হাসান আরও বলেন, আরব আমিরাতে কাজ পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু লাখ লাখ মানুষের জন্য নতুন করে কর্মসংস্থান এখানে নেই। ভাষাগত বা কোনও বিশেষ দক্ষতা থাকলে কাজ জোটানো যায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কাজ পাওয়া যাবেই— এমন প্রলোভন দেখিয়ে একটি চক্র হাজার হাজার মানুষকে দুবাই নিয়ে আসছে। যারা আসছেন, তাদের বেশিরভাগের নেই ভাষাগত দক্ষতা, জানেন না বিশেষ কাজও।

দুবাইয়ে ব্যবসা করেন তাজুল ইসলাম রফিক। গেলো কয়েক মাসে দুবাইতে বাংলাদেশিদের রাস্তায় পড়ে থাকা নিয়ে বিব্রত হওয়ার কথা জানালেন তিনি। বললেন, রাতে বেলায় খোলা আকাশের নিচে বাংলাদেশি শত শত যুবক শুয়ে আছে। এ দৃশ্য খুব পীড়া দেয়।

দুবাইয়ের মতিনা পার্ক, ইউনিয়ন মেট্রো সংলগ্ন পার্ক, ক্রিক নদীর কাছে অনেকেই রাত কাটায়। যেসব এলাকায় বাংলাদেশি বেশি, সেখানে এসে তারা থাকার জায়গা, কাজ, খাবারের জন্য হাত পাতে।

রফিক আরও বলেন, অনেকে সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশিদের সাহায্য করেন। কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে নিয়মিত সহায়তা করা তো সহজ নয়।

শারজাহ, আজমান, আবুধাবিতেও একই পরিস্থিতি। সেখানেও রাত হলে পার্ক, মেট্রো স্টেশন ও গলিতে ঘুমাতে দেখা গেছে বাংলাদেশিদের।

 

আব্দুর রশিদের স্বপ্ন ছিল আরব আমিরাতে গিয়ে তারকা হোটেলে কাজ করবেন। লাখ টাকা বেতনে বদলে যাবে জীবন। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয় দুদিনের মাথায়। তার রাত কাটছে দুবাইয়ের দেরা এলাকার মুতিনা পার্কে।

আব্দুর রশিদ বলেন, দুই লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। বলা হয়েছিল দুবাই গেলেই হোটেলে কাজ পাবো। এখানে যার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা সে বলছে এখন কাজ নেই, হলে জানাবে। এখন কোথায় থাকবো, কী করবো বুঝতে পারছি না। অন্য বাংলাদেশিদের মাধ্যমে জেনেছি, এই পার্কে রাতে থাকা যায়। তাই এখানে আছি। সঙ্গে যে টাকা আছে তাতে আর বড়জোর দুদিন খেতে পারবো।

কুমিল্লার মোহাম্মদ মাসুদের রাত কাটে ডেরার ইউনিয়ন মেট্রো স্টেশনের পাশের ফুটপাতে। কেমন আছেন জানতে চাইলেই কেঁদে ওঠেন। বলেন, বিপদে আছি। এখানে থেকে যেতেও পারছি না, থাকার অবস্থাও নেই। ঋণ করে এসেছি। বলা হয়েছিল মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবো। কীসের বেতন! কাজই পাইনি। একমাস হোস্টেলে সিট ভাড়া করে ছিলাম। এখন টাকা নেই ভাড়া দেওয়ার। রাস্তা ছাড়া উপায় নেই।

চার লাখ টাকা দিয়ে আমিরাতে এসেছেন হাফেজ মুফতি আব্দুর রহমান। মসজিদের ইমাম হিসেবে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাকে আনা হয়। এখন তিনি শারজাহ আল নাদা এলাকায় আছেন।

আব্দুর রহমান বলেন, ভিজিট ভিসায় আসার পর মসজিদের কাজের ভিসা দেওয়া হবে এমনটা বলা হয়। দেশে থাকতেই সাড়ে তিন টাকা লাখ নগদ দিয়েছি। এখানে এসে বাকি ৫০ হাজার দেবো বলেছিলাম। আমার সঙ্গে আমার চাচাতো ভাইও এসেছে। আসার পর দুই মাস ধরে বসে আছি। আরও ৫০ হাজার টাকা দিলে নাকি ভিসার ব্যবস্থা করবে।

তিনি আরও বলেন, এখানে আসার দুই মাস পর আমাকে ৯০০ দিরহামে ক্লিনারের কাজের কথা বলছে। মসজিদের ইমামের চাকরির কথা বলে এখন ক্লিনারের কাজের কথা বলছে। এ কাজ তো আমি জানি না। তারপর বলল, ফ্রি ভিসা দেবে। আরও টাকা লাগবে। আমি মায়ের জমি বিক্রি করে দেশ থেকে আরও ৪০ হাজার টাকা এনে দিলাম। এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছি।

দেশে ছুটিতে গিয়েছিলেন আব্দুল আজিজ। ছুটি শেষে ফিরে দেখেন তার রুমে বাড়তি আরও ৪ জন। আগে থাকতেন ৪ জন। এখন ৮ জন। ভাড়া গুনতে হচ্ছে আগেরটাই।

বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদের সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, ভিজিট ভিসায় প্রতিদিন শত শত ছেলে আরব আমিরাতে আসছেন। কাজ না পেয়ে তারা ডরমেটরি, হোস্টেলে যাচ্ছেন। সেখানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রুম ভাড়া বেড়েছে। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। গ্রামের পরিচিত বা আত্মীয় কেউ এলে তাকেও আশ্রয় দিতে হচ্ছে। রেস্টুরেন্টে খেতে বসলেই বাংলাদেশি কেউ না কেউ অনুরোধ করছে খেতে দিতে। এতে আরব আমিরাতে আগে থেকে বাস করা বাংলাদেশিরা বেশ বিব্রত অবস্থায় আছে।

হাবিবুর রহমান আরও জানালেন, আমরা সাংগঠনিকভাবে চেষ্টা করছি— যাদের দক্ষতা আছে, কিংবা কোনও কাজ জানেন, তাদের কোনও না কোনোভাবে সহায়তা করতে।

এদিকে কাজ না পেয়ে, আমিরাতে কাজের সন্ধানে আসা অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। প্রতারিতরা ক্ষুব্ধ হয়ে জড়াচ্ছেন বাগবিতণ্ডা, মারামারিতে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, যে লোকের কাজ জুটিয়ে দেওয়ার কথা, কিংবা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ছিল ভুক্তভোগীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকেও মারতে যাচ্ছে। কেউ হতাশা থেকেও অপরাধে জড়াচ্ছে। প্রবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে এখানকার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশিরা ভয়াবহ কোনও অপরাধ না করলেও, অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। তাই, যাদের দক্ষতা আছে বা যারা কাজের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন, তারা ছাড়া বাকিদের ভিজিট ভিসায় আমিরাতে না আসাই উচিত।






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *