Main Menu

সন্তানরা উচ্চবিত্ত, বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে: ‘মরে গেলেও বদদোয়া দেব না’

ডেস্ক রিপোর্ট:
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। রাজধানীতে তাদের ফ্ল্যাট আছে, প্লট আছে। জীবনের যত সঞ্চয় আছে, আনন্দ আছে-সবই সন্তানদের বিলিয়ে দিয়েছি। এখন একেবারেই নিঃস্ব, বড়ই একা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। বৃদ্ধাশ্রম কবরের মতোই। প্রার্থনা করি একটাই-আসল কবরের। আর্তনাত করি-দ্রুত মৃত্যু হলেই বেঁচে যাই।’

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বৃদ্ধাশ্রমের ৮৭ বছর বয়সি এক অসহায় বাবা। আলাপকালে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার অভিমত-যে বাবা নিজের রক্ত পানি করে চার সন্তানকে মানুষ করেছেন, সে সন্তানরাই বাবাকে ভুলে গেছেন। নাম প্রকাশ করতে চাননি। এমনকি সন্তানদের নাম, অবস্থানও জানাতে চান না তিনি।

‘সন্তানরা যদি নরকেও রাখে, ফেলে দেয়, তবু তাদের (সন্তান) অমঙ্গল চাইব না। না খেয়ে মরে গেলেও অপবাদ দেব না। বদদোয়া করব না। বেশ কয়েকবার চেষ্টাও করেছি আত্মহত্যা করতে, পারিনি। কারণ, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সমাজ জানবে না আমার প্রতি সন্তানরা কী জঘন্য অপরাধ করেছে।

তাছাড়া আমার পরিচয়ও গণমাধ্যমে আসবে না। কিন্তু আত্মহত্যা করলে, আমার পরিচয় জানাজানি হবে। জেনে যাবে আমার সন্তানদের পরিচয়ও। তখন সন্তানরা সমাজে ঘৃণার পাত্র হবে-এটি আমি মরে গেলেও বাবা হিসাবে কোনোদিন মেনে নিতে পারব না।

বৃদ্ধাশ্রমটিতে তার মতো আরও ১৪ জন বাবা এবং ১৬ জন মা রয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই বিত্তশালী। কেউ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সচিব কেউ বা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। আবার আছেন বিত্তশালী ব্যক্তির স্ত্রীও।

বৃদ্ধাশ্রমটির চতুর্থতলায় বারান্দায় বসে কী যেন ভাবছিলেন ৮০ ছুঁইছুঁই বয়সি এক মা। পাশে যেতেই বললেন, কীসের জন্য এসেছো, কোনো কথাই বলব না। একপর্যায়ে বললেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। অধ্যাপক জাফর ইকবাল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। স্বামীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। পুলিশের ডিএসপি ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে স্বামী মারা যান। দুই সন্তান থেকেও নেই।

বাবার বিশাল সম্পদ, বরিশাল তালুকদার বাড়ির মেয়ে তিনি। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ৮ তলা বাড়ি আছে। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি মেজো। ওই বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তার। আক্ষেপ করে বলেছেন, ওই বাড়ির এক কোনায় কিংবা সন্তানদের বাসার এক পাশে যদি একটু জায়গা হতো, তাহলে সন্তান, ভাই, ভাইদের ছেলেমেয়ে, স্বজনদের দেখতে পেতেন। নিজেকে শূন্য মনে হতো না। বেঁচে থাকারও ইচ্ছা থাকত। যেমনটা এখন পান না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছে-গাজীপুর বয়স্ক পুনর্বাসন-বৃদ্ধাশ্রম কেন্দ্র। যেখানে বর্তমানে ১৭০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। এখানে বিত্তশালী নারী-পুরুষ বিনামূল্যে থাকছেন। নিজেকে সমাজ থেকে আড়াল করে নিয়েছেন। সন্তান-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ বড়ই একা।

রাজধানীতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বৃদ্ধাশ্রম ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে সারা দেশে অন্তত ১২টি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। রাজধানীতে কিছু বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র/বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে-যেখানে টাকার বিনিময়ে বয়স্কদের রাখা হয়। এসব কেন্দ্রে একসময় যারা বিত্তবান ছিলেন, এখন নিঃস্ব-তাদের একটি বড় অংশই মাসিক টাকা দিয়ে থাকছেন। বিভিন্ন বিভাগেও পেইড বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. কামরুজ্জামান জানান, সরকারি পর্যায়ে কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই। আমাদের ৮৫টি শিশু পরিবার রয়েছে। প্রতিটি শিশু পরিবারে ১০ জন করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকতে পারেন। তবে আমরা ৮টি বিভাগের ৮টি জেলায় ‘শান্তি নিবাস’ নামে বিশেষ ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতিটি শান্তি নিবাসে ২৫ জন করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বিনামূল্যে রাখা হবে। তিনি বলেন, এখনো বিভিন্ন স্থানে পেইড সিস্টেমে বয়স্ক কেন্দ্র বা বৃদ্ধাশ্রম করা হচ্ছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সমাজে বিত্তশালীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্তান মা-বাবাকে আলাদা করে দিচ্ছে কিংবা পরিবার থেকে বের করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ পরিবারে থেকেও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ঘর-বা বাসার কোনো কোনায় মা-বাবাকে রেখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন ঘরে-বাইরেও বৃদ্ধাশ্রম চোখে পড়ছে। অনেকের একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট রয়েছে। ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষায় অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদেশে রয়েছেন। বছরের পর বছর মা-বাবাকে দেখতে আসছেন না। এদের একটি বড় অংশই বিত্তের মধ্যে থেকেও একা জীবনযাপন করছেন। যাদের অনেকেই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কেউ আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

কেউ আবার চাকরি কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদেশে থাকছেন আর দেশে থাকা মা-বাবাকে বয়স্ক বা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাচ্ছেন। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা আবাসিকদের কারও বয়স ৭০, কারও ৯০ পেরিয়েছে। কেউ আবার ৯০ পেরিয়ে জবুথবু অবস্থায় প্রায় শয্যাশায়ী।

মনোবিজ্ঞানী ড. আনোয়ারা সৈয়দ হক জানান, দীর্ঘদিন ধরে চার দেওয়ালের মধ্যে কাটানোর প্রভাব পড়তে পারে বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের মানসিক স্বাস্থ্যে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে প্রত্যেকের মেলামেশাটা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকলে প্রবীণদের স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব পড়তে পারে। এটি শুধু ব্রদ্ধাশ্রমে নয়। নিজ গৃহে, গৃহের অন্দরমহলেও হতে পারে। কারণ সমাজের মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সামগ্রিকভাবে বাঁচতে চায় না। বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি, টাকাপয়সা সব রেখেই চলে যেতে হয়। কিন্তু এসব নিয়ে মানুষ নিজেদের মধ্যেই রক্ত ঝরায়।

তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া কি ঠিক। কয়টা মানুষ ওইসব অস্ত্র দিয়ে নিজেকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচায়? বরং নিজের পিস্তল দিয়ে নিজে, নিজের পরিবার কিংবা অন্য কাউকে হত্যা করা হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। নিজেকে শক্তিশালী মনে করছে। অস্ত্র থাকা মানে নিঃস্ব বিকারগ্রস্ত মানুষের কাছে একটি আত্মহত্যার বড় অস্ত্র থাকা।

তিনি বলেন, সম্পদ নিয়ে সাধারণ মানুষ নন, বিত্তশালীরাই সম্পদ নিয়ে মা-বাবা, ছেলে-সন্তান আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে সন্তানদের পড়াশোনা করতে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এটা মা-বাবারাই করছেন। নিজের অর্জিত টাকাপয়সা, সম্পদ বিক্রি করে সন্তানদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে যুবক-যুবতি বয়সে।

৬/৭ বছর পড়াশোনা করে তারা দেশে আসতে চাচ্ছে না-এটাই তো নিয়ম। মা-বাবা জেনেশুনেই এমনটা করছেন। সমাজে নিজেকে বড় করে তুলতে চান বিদেশে সন্তানদের পাঠিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, একা থাকলেই যে নিঃস্ব-হতাশ হতে হবে, তা কিন্তু নয়। মানুষকে সমাজে সম্পৃক্ত থেকেও বাঁচতে হয়। সমাজের মানুষের সঙ্গে চলতে হয়। নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকাও রয়েছে। বয়স্ক মানুষের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে সময় দিতে হবে। ভালো কাজে সবাই মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সমাজে অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলতে হবে। হতাশা থেকে আত্মহত্যা কিংবা নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। তবে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব হবে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায়।






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *