Main Menu

দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ

মুফতি আসিম নাজিব, অতিথি লেখক:
প্রত্যেক মুসলমান প্রতিদিন কিছু না কিছু আল্লাহ তাআলার কাছে চেয়ে থাকেন। যারা আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, তাদের কারও দোয়া কবুল হয়, আবার কারও হয় না। আর দোয়া কবুল না হওয়ার অবশ্যই কোন না কোনো কারণ রয়েছে।

অনেক মানুষ আছেন, আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করার পরও প্রত্যাশিত বিষয় না পেলে— দোয়া করা ছেড়ে দেন। হতাশ হয়ে অধৈর্য হয়ে পড়েন। তাদের জানা থাকা দরকার যে, দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে তিনটি বিষয়ের কোনো একটি দিয়ে থাকেন।

এক. হয়তো প্রত্যাশিত বিষয়টি দিয়ে দেন। দুই. দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর থেকে সমপর্যায়ের বিপদ দূর করেন। তিন. দোয়ার সওয়াব আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে তাকে দান করবেন। তাই দোয়ার পর প্রত্যাশার বিপরীত কোনো কিছু ঘটলেও ধৈর্য ধরা— অধৈর্য না হওয়া।
যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না

বিভিন্ন কারণে আমাদের দোয়া কবুল হয় না। কিন্তু কেন আমাদের দোয়া কবুল হয় না— সে কারণগুলো আমরা জানি না। জেনে রাখার প্রয়োজনও মনে করি না। তাই আসুন, সেসব কারণ জেনে নেই।

এক. পানাহার ও পোশাক হালাল না হওয়া

হারাম খাওয়া ও হারাম উপার্জনের কারণে মানুষের দোয়া কবুল হয় না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পবিত্র; তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন।… তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন— দীর্ঘ সফরের ফলে যার চুল উসকোখুসকো, চেহারা ধুলোবালিমাখা। সে হাত দুটো আকাশের দিকে উঠিয়ে বলছে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’, কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম আর তার পরিপুষ্টি হয়েছে হারাম দিয়ে; (এমতাবস্থায়) কীভাবে তার দোয়ায় সাড়া দেওয়া হবে?’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০১৫)

রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘মানুষের ওপর এমন এক যুগ অবশ্যই আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে কিভাবে সে সম্পদ অর্জন করল, হালাল উপায়ে, নাকি হারাম উপায়ে!’ (বুখারি, হাদিস : ২০৮৩)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৩৬)

তাই দোয়া কবুল হওয়ার জন্য অবশ্যই হালাল ভক্ষণ করতে হবে। হালাল উপায়ে উপার্জন করতে হবে। জেনে রাখা উচিত যে, সফরে দোয়া কবুল হয়, হাত উঠিয়ে দোয়া করলে কবুল হয় এবং নিজেকে হীনজ্ঞান করে আল্লাহকে কায়মনো বাক্যে ডাকলেও দোয়া কবুল হয়; কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়— এতগুলো শর্ত লোকটি পূরণ করার পরও তার দোয়া কবুল হচ্ছে না। আর তা কেবল হারাম খাবার, পানীয় ও পোশাকের জন্য। (ইবনু রজব হাম্বলি, জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম)
দুই. দোয়ায় ইখলাস ও নিষ্ঠাহীনতা

মহান আল্লাহর দরবারে ইখলাসের সঙ্গে দোয়া করতে হয়। পরিপূর্ণ ইখলাস না থাকলে সে দোয়া বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, দোয়াও একটি ইবাদত। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৭৯)

ইবাদত করতে হয় একমাত্র আল্লাহর জন্য। ইখলাসহীন ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। তাইতো পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের শুধু এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বিনকে একনিষ্ঠ করে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে। আর এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা বায়্যিনাহ, আয়াত : ০৫)

তিন. গুনাহ করা ও রক্তের বন্ধন ছিন্ন করার দোয়া

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি বড় ধরনের পাপ (অপরাধ)। এই পাপের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলিম দোয়া করার সময় কোনো গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দোয়া না করলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে এ তিনটির কোনো একটি দান করেন।

(১) হয়তো তাকে তার কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ দুনিয়ায় দান করেন। (২) অথবা তা তার পরকালের জন্য জমা রাখেন। (৩) অথবা তার কোনো অকল্যাণ বা বিপদাপদ তার থেকে দূরে করে দেন।

সহাবিরা বলেন, তাহলে তো আমরা অনেক বেশি লাভ করব। তিনি বলেন, আল্লাহ এর চেয়েও বেশি দেন। (আত-তারগিব, হাদিস : ১৬৩৩)

চার. গুনাহে অবিচলত থাকা

দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, গুনাহ ত্যাগ করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। অতএব, দোয়া কবুল হওয়ার জন্য গুনাহ ত্যাগ করে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত। কারণ যারা নিজেকে বদলায় না, মহান আল্লাহও তাদের বদলান না।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন, তবে তা রদ হওয়ার নয়। এবং তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক নেই। (সুরা রাদ, আয়াত : ১১)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দার দোয়া সর্বদা গৃহীত হয় যদি না সে অন্যায় কাজ অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্য দোয়া করে এবং দোয়ায় তাড়াহুড়া করে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৮২৯)

পাঁচ. দোয়ায় অমনোযোগী হওয়া

দোয়ায় মনোযোগ না থাকলেও সে দোয়া আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কবুল হওয়ার পূর্ণ আস্থা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো, তোমরা জেনে রাখো যে আল্লাহ নিশ্চয়ই অমনোযোগী ও অসাড় মনের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৭৯)

ছয়. দোয়া কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করা

অনেক সময় মানুষ দোয়ার ফলাফল পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে। দোয়া করার পর দ্রুত ফলাফল না পেলে হতাশ হয়ে পড়ে। এমনকি এ রকমও বলতে শুরু করে যে আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেন না। এতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ফলে তার দোয়া বিফলে যাওয়াই স্বাভাবিক।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়ে থাকে। যদি সে তাড়াহুড়া না করে এবং এ কথা না বলে যে আমি দোয়া করলাম, কিন্তু আমার দোয়া তো কবুল হলো না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩৪০)
অতএব, দোয়া করার ক্ষেত্রে কখনো তার ফলাফল পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না এবং ফলাফল পেতে দেরি হলে আল্লাহর ব্যাপারে অসংলগ্ন কথা বলা যাবে না।

সাত. সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে না করা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘শপথ সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দিবে ও অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করবে। নতুবা, অচিরেই এর ফলে আল্লাহ্ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে, কিন্তু তোমাদের দোয়া সাড়া দেওয়া হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৯)

আট. দ্রুত ফল না পাওয়ায় দোয়া বন্ধ করে দেওয়া

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ আল্লাহকে ডাকলে, তার ডাকে সাড়া দেওয়া হবে, যতক্ষণ না সে অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে— ‘আল্লাহকে তো ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া তো পাওয়া গেলো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৪০)

নয়. হারাম থেকে বেঁচে না থাকা

দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে হারাম খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা। হারাম উপার্জনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে যতই দোয়া করা হোক, তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না। রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলামলিন। সে আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ৮৯৬৯)

দশ. মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা

তিনি দোয়া সাথে সাথে কবুল না করে প্রার্থিত বস্তুর চেয়েও অধিক দেওয়ার জন্য রেখে দেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখনই কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক নষ্ট করা ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন: হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে দিয়ে দেন অথবা তার দোয়াকে তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন কিংবা দোয়ার পরিমাণ অনুসারে তার অন্য কোনো (অনাগত) বিপদ তিনি দূর করে দেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৫/৫৬৬; আহমাদ, হাদিস : ৩/১৮)

মহান আল্লাহ আমাদের সবার ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করুন। সবাইকে দোয়া কবুলে প্রতিবন্ধক অভ্যাসগুলো ত্যাগ করে সঠিকভাবে দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।






Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *