Main Menu

ফরজ সুন্নত ওয়াজিব নফল কী?

মুফতি মাহমুদ হাসান, অতিথি লেখক:

শরিয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধানাবলি স্তরভেদে বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। কোরআন-হাদিসের বর্ণনায় ইসলামী সব বিধানের স্তরবিন্যাস সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও উম্মতের ফকিহ ও আইনবিদরা কোরআন-সুন্নাহে গবেষণা করে বিধানাবলিকে বিভিন্ন স্তরে রূপ দিয়েছেন এবং সেগুলো সুবিন্যস্ত করেছেন।

আদেশসমূহ যথা—ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব ইত্যাদি। আর নিষেধসমূহ যথা— হারাম ও মাকরুহ ইত্যাদি। আর কিছু জিনিস রয়েছে আদেশ-নিষেধ কোনোটিই নয়, বরং শুধু বৈধতার পর্যায়ে পড়ে। নিম্নে এগুলোর সংজ্ঞা ও বিধান উল্লেখ করা হলো—

ফরজ

ফরজ ওই আদেশমূলক বিধানকে বলা হয় যা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং তার অকাট্যতার ওপর নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস রাখা ও আমল করা অপরিহার্য। কোনো ওজর ব্যতীত তা ত্যাগকারীকে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয় এবং তার অস্বীকারকারী ‘কাফির’ বলে গণ্য হয়। (উসুলে সারখসি : ১/১১০)

ফরজ দুই প্রকার : ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া।

ফরজে আইন : ফরজে আইন ওই ফরজ বিধান, যার ওপর প্রত্যেক দায়িত্বশীল তথা প্রাপ্তবয়স্ক বিবেকবান মুসলিমের আমল করা অপরিহার্য। অর্থাত্ এক দলের আমলের কারণে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হয় না, বরং দায়িত্বশীল প্রত্যেক মুসলিমের ওপর আবশ্যক। যথা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জাকাত, রমজানের রোজা ও হজ এবং প্রয়োজন পরিমাণ জরুরি দ্বীনি ইলম অর্জন ইত্যাদি।

ফরজে কিফায়া : ফরজে কিফায়া ওই ফরজ বিধান যা প্রত্যেক দায়িত্বশীল মুসলিমের ওপর ব্যক্তিগত পর্যায়ে অপরিহার্য হয় না, বরং মুসলিম সমাজের ওপর এমনভাবে আরোপিত হয় যে এক দল মুসলিম তা সঠিকভাবে আমলের মাধ্যমে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়, তবে কেউ তা না করলে সকলেই গোনাহগার হবে। যথা পরিপূর্ণ দ্বিনি জ্ঞানার্জন করা, সত্ কাজের আদেশ ও অসত্ কাজে বাধা প্রদান এবং মুসলিম জাতির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ইত্যাদি।

ওয়াজিব

ওয়াজিব ওই আদেশমূলক বিধানকে বলা হয় যা অকাট্য প্রাধান্যযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং তার ওপর আমল করা অপরিহার্য। তার অকাট্যতার ওপর সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য না হলেও তার ওপর আমল করা অপরিহার্য। কোনো ওজর ব্যতীত তা ত্যাগকারী গুনাহগার হবে এবং তার অস্বীকারকারী ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয়, তবে ‘কাফির’ বলা যাবে না। যথা— বিতর নামাজ, সদকাতুল ফিতর ও কোরবানি ইত্যাদি।

সুন্নত

সুন্নত ওই আদেশমূলক বিধানকে বলা হয়, যা ফরজ-ওয়াজিবের মতো অপরিহার্য না হলেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়মিত আমল থেকে তা প্রমাণিত।

সুন্নত দুই প্রকার : সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও সুন্নতে জায়েদা।

সুন্নতে মুয়াক্কাদা : সুন্নতে মুয়াক্কাদা ওই সুন্নত, যার ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত এমনভাবে আমল করতেন যে তা ওজরবিহীন (বিশেষ অপারগতা) কখনো ছাড়তেন না। যথা—পুরুষরা জামাতে নামাজ পড়া, জামাতের জন্য আজান দেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের ইবাদতের বিধান হলো—ওজরবিহীন নিয়মিত ছেড়ে দেওয়া গুনাহ, তবে প্রয়োজনে হঠাত্ ছাড়তে পারে। মাঝে মাঝে অপ্রয়োজনে ওজরবিহীন ত্যাগকারীকে তিরস্কার করা হবে, তবে ফাসিক বা কাফির বলা যাবে না।

সুন্নতে জায়েদা : সেসব সুন্নত, যার ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত আমল করলেও ওজরবিহীন মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিতেন। তাকে মুস্তাহাব, নফল, মানদুবও বলা হয়। তার বিধান হলো—তার ওপর আমল করা প্রশংসনীয় ও সওয়াবের কাজ। তবে অপ্রয়োজনে ওজরবিহীন ত্যাগকারীকে তিরস্কার করা যাবে না। যথা তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল সদকা ও নফল হজ, পরোপকার করা ও জনসেবামূলক কাজ করা ইত্যাদি। তবে এ ধরনের আমলগুলোর মধ্যে কোনো কোনো আমল অন্য আমলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। কোনো কোনো ওলামায়ে কেরামের মতে, মুস্তাহাব-নফলের চেয়ে সুন্নতে জায়েদা তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ। (কাশফুল আসরার : ২/৩০২)

হারাম

হারাম হলো ফরজের বিপরীত। অর্থাৎ হারাম ওই নিষেধমূলক বিধানকে বলা হয়, যা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং তার অকাট্যতার ওপর নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস রাখা ও তা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। কোনো ওজর ছাড়া তাতে লিপ্ত ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য এবং তাকে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয় এবং তার নিষিদ্ধতার অস্বীকারকারী ‘কাফির’ বলে গণ্য হয়। যথা : ব্যভিচার, মদপান, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা অন্যের সম্পদ আত্মসাত্, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ-ঘুষ গ্রহণ, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া ও ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদি।

মাকরুহ

মাকরুহ ওই নিষেধমূলক বিধানকে বলা হয়, যা অকাট্য প্রাধান্যযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। তবে ওজর ব্যতীত তাতে লিপ্ত ব্যক্তি ‘ফাসিক’ ও শাস্তিযোগ্য নয়।

মাকরুহ দুই প্রকার : মাকরুহে তাহরিমি, মাকরুহে তানজিহি।

মাকরুহে তাহরিমি : মাকরুহে তাহরিমি ওই মাকরুহ, যা হারামের পর্যায়ে না হলেও নিষিদ্ধতার মধ্যে তার কাছাকাছি। তাই ওজর ছাড়া তাতে লিপ্ত ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য না হলেও গুনাহগার ও তিরস্কারযোগ্য হবে। যথা : দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার জন্য পণ্য গুদামজাত করা ইত্যাদি। এ প্রকারকে ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদার বিপরীত বলা যায়।

মাকরুহে তানজিহি : ওই মাকরুহ, যা হালালের পর্যায়ে না হলেও বৈধতার মধ্যে তা হালালের কাছাকাছি। তা থেকে বিরত ব্যক্তি প্রশংসাযোগ্য, তবে কখনো কখনো কেউ তাতে লিপ্ত হলে সে তিরস্কারযোগ্য নয়। যথা : অপ্রয়োজনে ধূমপান ও তামাক সেবন ইত্যাদি। এ প্রকারকে সুন্নতে জায়েদা ও মুস্তাহাবের বিপরীত বলা যায়। (উসুলে সারখসি : ১/১১০)

মুবাহ : মুবাহ ওই সব কাজকে বলা হয়, যা শরিয়তের পক্ষ থেকে কোনো প্রকারের আদেশও করা হয়নি, আবার কোনো প্রকারের নিষেধও করা হয়নি। তাকে মুবাহ বা জায়েজ বলা হয়। যথা : দুনিয়াবি বিভিন্ন কাজকর্ম। তবে ক্ষেত্রবিশেষ ও ভালো নিয়তের কারণে মুবাহ কাজ মুস্তাহাব তথা সাওয়াবের কাজও হতে পারে, আবার ক্ষেত্রবিশেষ খারাপ নিয়তের কারণে তা গুনাহের কারণও হতে পারে। যথা : কারিগরি শিক্ষা হালাল রিজিক অর্জনে, জনসেবা ও দ্বিনের কাজে সহযোগিতার নিয়তে শিখলে তা অনেক সাওয়াবের কাজ, আবার গুনাহের কাজে সহযোগিতার নিয়তে শেখা গুনাহের কাজ। (আলআশবাহ ওয়ান্নাজায়ের : ১/২৩)

মুফতি মাহমুদ হাসান।। ফতওয়া-গবেষক ও মাদরাসাশিক্ষক






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *