Main Menu

খানজাহান আলী: একজন সেনাপ্রধান, ধর্ম প্রচারক ও শাসকের গল্প

নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের বাগেরহাটে খানজাহান আলীর বসতভিটায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খননকাজ চালিয়ে সুলতানি আমল এবং মুঘল আমলের মৃৎপাত্র নিদর্শন পাওয়া গেছে। ছয়শো থেকে সাড়ে ছয়শো বছর আগের স্থাপত্য রীতির নমুনা সম্বলিত দেয়াল, মেঝেসহ ঘরের কাঠামো এবং মাটির তৈরি পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ জাতীয় জিনিস পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বিবিসিকে বলেন, খানজাহান আলীর এই বসতভিটায় গত কয়েক বছর ধরে খননকাজ চলছে। মাঝে কয়েক বছর বিরতি দিয়ে এ বছর আবার কাজ শুরু হয়েছে, জানুয়ারির শেষে এ বছরের মত যা শেষ হবে। প্রাথমিক অনুমানে এই জায়গাটিকে প্রাচীন টাকশাল নগরী মনে করে খননকাজ শুরু করা হয়।

কে ছিলেন খানজাহান আলী
বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায় তার নাম খান জাহান নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি কাগজপত্রে তাকে হযরত খানজাহান আলী (র:) নামে সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি দীর্ঘ সময় যোদ্ধা, শাসক এবং ধর্ম প্রচারক হিসেবে কাজ করলেও, নিজের পরিচয় সম্বন্ধে তিনি কিছু লিখে রেখে যাননি।

এমনকি তার কোন ছবিও পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে লেখা হয়েছে, তাঁর সমাধিসৌধের ফলকে তার নাম লেখা আছে ‘উলুগ খান’ ও ‘খান-ই-আযম’। সমাধিফলকে উৎকীর্ণ তার উপাধি থেকে ধারণা করা হয় যে, খানজাহান আলী নিছক একজন স্বাধীন সৈনিক ছিলেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার বিবিসিকে বলছিলেন, খানজাহান আলী দ্বিতীয় ইলিয়াসশাহী শাসনের সময় অর্থাৎ ১৪ শতকের শেষের দিকে বাংলায় আসেন বলে মনে করা হয়।

যোদ্ধা পরিচয়ে আগমন
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, খানজাহান আলী ছিলেন ‘একজন সুফিসাধক এবং বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এলাকার আঞ্চলিক শাসক’।

তিনি পনেরো শতকের প্রথমার্ধে তৎকালীন খলিফাতাবাদ যা এখন বাগেরহাট নামে পরিচিত, তার শাসনকর্তা হন। প্রথমে দিল্লির সুলতানের কাছ থেকে এবং পরে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে সুন্দরবন বনাঞ্চল জায়গীর লাভ করেন। বাংলায় তার আগমন ঘটেছিল একজন যোদ্ধা হিসেবে।

ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার বিবিসিকে বলছিলেন, “খানজাহান আলী বাংলায় আগমন করেন একজন সেনাপতি হিসেবে। তবে যোদ্ধা পরিচয় ছাপিয়ে তার জনহিতকর কাজ এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারক পরিচয়ই শত শত বছর ধরে মানুষের মনে আছে।”

আউলিয়া, ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ
সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার বলছেন, ১৫শ শতকের প্রচলিত ব্যাপার ছিল যে শাসক, বা সেনাপতির মত শীর্ষ পদের অধিকারী ব্যক্তিদের হাত ধরে ধর্ম প্রচার, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের প্রচার এবং প্রসার হয়েছিল।

তিনি বলছেন, শাসক হিসেবে কাজ শুরু করে স্থানীয় মানুষের প্রয়োজন চিহ্নিত করে কাজ করেন। রিচার্ড এম ইটন নামে একজন অ্যামেরিকান ইতিহাসবিদের লেখা ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ নামে বইয়ে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাট অঞ্চলে লবণাক্ত পানির বদলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করার জন্য দিঘী খনন করে খানজাহান আলী জনপ্রিয়তা পান।

ওই অঞ্চলের পানি লবণাক্ত হবার কারণে স্বাদু পানির অভাব ছিল। একই সঙ্গে সুন্দরবনের ঘন বনজঙ্গলের কারণে এলাকাটি ছিল দুর্গম। খানজাহান আলী তার সৈন্যবাহিনী ও স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে মিঠাপানির ব্যবস্থা করার জন্য বহু দিঘি খনন করেন এবং জঙ্গল কেটে চাষের জমি বের করেন।

বাংলাদেশের জাতীয় তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, তিনি প্রায় ৩৬০টির মত দিঘি খনন করেছিলেন। এসব পদক্ষেপের কারণে স্থানীয় মানুষের জীবন ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিল। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে, পরবর্তীতে তিনি যখন ধর্ম প্রচার করেছেন মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে। বইটিতে আরো বলা হয়েছে তিনি অসংখ্য মসজিদ এবং রাস্তাঘাট তৈরি করেছিলেন।

সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার মনে করেন, খুলনা-বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসারে খানজাহান আলী এবং তার অনুসারীদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।

সুশাসক
পনের শতকে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে খানজাহান আলীর ব্যাপক অবদান রয়েছে বলে মনে করেন সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার। তবে, প্রথমে যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তীতে ধর্ম চিন্তা এবং জনসেবাতেই তিনি বেশি নিয়োজিত ছিলেন।

স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি ছিলেন একজন আউলিয়া বা অলৌকিক ক্ষমতাবান মহাপুরুষ। যদিও তার অলৌকিক কোন ক্ষমতা ছিল এমন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে তার জনহিতকর কাজের জন্য স্থানীয় মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছিল, সেটি তাকে আউলিয়া ভাবার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন সুরাইয়া আক্তার।

তার সময়ে স্থানীয়ভাবে কোন নিপীড়ন বা সহিংসতার কথা শোনা যায় না। খানজাহান আলীর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-কীর্তির মধ্যে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং খানজাহান আলী দিঘি বা খাঞ্জালি দিঘি অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ ইউনেস্কোর দেয়া বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি।

এছাড়া খানজাহান আলী দিঘির এক পাশে খানজাহান আলীর মাজার, বা তার সমাধি সৌধ রয়েছে। প্রতিবছর বহু মানুষ মাজার জিয়ারত করতে যান।






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *