কুশিয়ারা নদী পারের মানুষের দূর্দশার শেষ কোথায়?
আবুজার বাবলা, বিয়ানীবাজার ফিরে:
জমি-জমা, বাড়ি-ঘর, গোয়ালে গরু, পুকুর ভরা মাছ- কোন কিছুরই অভাব ছিল না। জমির ফসল সারা বছর খেয়ে পরে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করা যেত। এভাবেই কুশিয়ারা নদী পারের কয়েক গ্রামের মানুষের স্বচ্ছল জীবন চলছিল। অভাব কখনও তাদের স্পর্শ করেনি। সেই মানুষ গুলো সব হারিয়ে এখন পথের ভিখেরি।
এমন হাজারো মানুষের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আজো বয়ে চলেছে কুশিয়ারা।
ক্রমাগত নদী ভাঙ্গনে শেওলা ইউনিয়ন এখন হারাতে বসেছে তার অস্তিত্ব। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে অনেক স্বচ্ছল মানুষ হারিয়েছে জমি, বাড়ি ঘর। অনেকটা নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। শুধু বাড়ি ঘর না খরশ্রোতা কুশিয়ারার ভয়াল থাবায় নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে এই জনপদের বিস্তর্ণ জমি, হাট- বাজার, স্কুল। কুশিয়ারার ভাঙ্গনরোধে সরকারী বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও এ অঞ্চলের মানুষের তা কোন কাজেই আসেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।
যুগ যুগ ধরে কুশিয়ারা পাড়ের মানুষের নদী ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের যেন শেষ নেই। কুশিয়ারা পারের এসব দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের সহায়তায় সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার প্রবনতা খুব কম।
কুশিয়ারা বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। এর উৎস বরাক বা বরবক্র নদী। প্রাচীনকালের স্বাধীন রাজ্য মনিপুরের আঙ্গামিনাগা পাহাড়ের ৩শ’ কিমি উঁচু স্থান থেকে বরাক নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থান থেকে ৪৯১ কিমি অতিক্রম করে সিলেটের সীমান্তে এসে বরাক নদী দুই শাখায় সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত। নদী দুটো সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে ধর্তব্য। সিলেটের সীমান্ত থেকে উত্তরে প্রবাহিত স্রোতধারাকে সুরমা নদী এবং দক্ষিণে প্রবাহিত স্রোতধারাকে কুশিয়ারা নামে অবহিত করা হয়।
কুশিয়ারার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১ কিমি, গড় প্রস্থ ২৫০ মিটার এবং বর্ষা মৌসুমে গড় গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। কুশিয়ারা নদী আসাম রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রচুর পানি এবং পলি বহন করে নিয়ে আসে।
সিলেটের প্রাচীনতম জনপদ বিয়ানীবাজার। কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী শেওলা ইউনিয়ন এই জনপদের রাক্ষুসি কুশিয়ারার পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে উদাস তাকিয়ে এই আক্ষেপ করেন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষেরা। তারা বলেন, এই নদী তাদের সব কেড়ে নিয়েছে, কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। ২০ বছর আগে সব হারিয়ে তারা নদীর অভিশাপ থেকে বাচঁতে সিলেট ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
কুশিয়ারা নদী তীরের মানুষগুলোর দুর্ভোগ দুর্দশা নিয়ে এই জনপদের অধিবাসী আলী আক্তারুজ্জামান বাবুল নামে এক সমাজকর্মী দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাথে নিয়ে সভা, পথযাত্রা, পানি উন্নয়ন বোর্ডে স্বারকলিপি দেয়া, মানববন্ধন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মতো নানা কর্মসূচি পালন করেছেন নিজের উদ্যোগে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি সবার কাছে গেছেন। কিন্তু সবাই শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
রোববার দুপুরে বিয়ানিবাজার ঘুরে সিলেট শহরে বাসায় এ নিয়ে তার সাথে কথা হয়। সাদামাটা জীবন যাপন বাবুলের। এলাকায় পরিচ্ছন্ন ইমেজ রয়েছে। বাংলা পোর্টালের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাবুল বলেন, কুশিয়ারা নদীর কড়াল গ্রাস থেকে নদী পারের মানুষের কান্না যেন থামছেই না।
গত ৪ দশকে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১০টিরও বেশি গ্রাম নদীতে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে শেওলা ইউনিয়নেই গৃহহীন হয়েছে শতাধিক পরিবার। অসময়ের ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে প্রতিষ্ঠিত পরিবারের অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে ছিন্নমূলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। শেষ সম্বলটুকুও মিশে গেছে নদীতে। উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে চলা খরস্রতা কুশিয়ারা যুগ যুগ ধরে ক্রমাগত ভাঙ্গনে শেওলা বাজার, দিগলবাক, কাকরদি, ঢেউনগর, বালিঙ্গা, শালেশ্বর ও কোনা শালেশ্বর গ্রামের, বসতবাড়ি, ঈদগাহ, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, ক্লাব, রাস্তা-ঘাট ছাড়াও শত শত একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। শেওলার কোনা শালেশ্বর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর আলী ওয়াকিউজ্জামান এর গ্রামের বাড়ি ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমাখা এই বাড়িটিও নদীর গর্ভে এখন বিলিন।
নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানিকগঞ্জ ও অমরগঞ্জ বাজারও নদীতে।
কিন্তু আমরা এনিয়ে কিছুই করতে পারিনি। বাবুল বলেন, যদিও নদী শাসন নিয়ে আমাদের অনেক কিছু করার ছিল। কুশিয়ারা নদী শাসন নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রনে যে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে তা এ অঞ্চলের ভাঙ্গন উপদ্রুত মানুষের কোন কাজে আসেনি। তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের দিকে শেওলা ইউনিয়নের তৎকালিন চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান চৌধুরী এনার প্রচেষ্টায় কয়েক অংশে বন্যা নিয়ন্ত্র বাধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দেখা দিয়েছে। অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ দেয়ায় এক এলাকায় ভাঙ্গন বন্ধ হলেও আরেক এলাকায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। ফলে সরকারের এসব অর্থ অপচয়ের খাতায় গেছে।
সমাজকর্মী আলী আক্তারুজ্জামান বাবুল জানান, শত শত পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাবার আশংকা করে তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলেও স্থানীয় সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা দায়িত্ব প্রাপ্ত কোন সরকারি বিভাগ এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তিনি দ্রুত কুশিয়ারা নদী শাসনে কার্যকর প্রকল্প হাতে নেয়ার আহবান জানান।
যোগাযোগ করা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম বারী এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের আওতায় কুশিয়ারা ও সুরমা নদী শাসন বিষয়ে বোর্ডের অধীন একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জরিপ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। অতীতে এই দুই নদী শাসনে পাউবোর প্রকল্প কাজে আসেনি স্থানীদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে এই প্রকৌশলী বলেন, নদী শাসনে বি আই ডাব্লুউটির অধীন নদীর ড্রেজিং, ২০০৪ সালে যেসব বাঁধ দেয়া হয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার বেশ কিছু অংশের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। তবে টেকসই প্রকল্প গ্রহনে এসব সমস্যা চিন্হিত করতে নতুন জরিপ কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
Related News
মাধবপুরে পাঁচ বছর ধরে বন্ধ পাবলিক লাইব্রেরি
মাধবপুরে পাঁচ বছর ধরে বন্ধ পাবলিক লাইব্রেরি বছরের পর বছর ধরে বন্ধ থাকায় হবিগঞ্জের মাধবপুরRead More
কুয়েত থেকে লাশ হয়ে ফিরল শালা-দুলাভাইের নিথর দেহ
কুয়েত থেকে লাশ হয়ে ফিরল শালা-দুলাভাইের নিথর দেহ আরব উপদ্বীপের দেশ কুয়েত থেকে কফিনে করেRead More