প্রবাসী ভারতীয়দের কোন জাদুতে বশ করেছেন মোদী

নিউজ ডেস্ক:
আগামী শুক্রবার (২৩শে জুন) ওয়াশিংটন ডিসি-র রোনাল্ড রেগন সেন্টারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যে সভা অনুষ্ঠিত হবে তাতে হাজির থাকার জন্য আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়রা দলে দলে ভিড় করছেন। এই অনুষ্ঠান শুধু ‘আমন্ত্রিত অতিথি’দের জন্য, তারপরও এক একটা টিকিটের জন্য চলছে হাহাকার!
এর ঠিক আগের দিন মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেখানেও দর্শক গ্যালারির একটা আসন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা যাতে নিজের কোটা থেকে বরাদ্দ করে দেন সে দেশের ভারতীয়রা সে জন্য তাদের ব্যতিব্যস্ত করে মারছেন।
হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে প্রেসিডেন্ট বাউডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন মোদীর সম্মানে যে ‘রিসেপশন’ দিচ্ছেন, সেখানেও দর্শক হিসেবে ‘রেজিস্ট্রেশন’ করানোর জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে ধূম পড়ে গেছে।
আসলে প্রধানমন্ত্রী মোদী আমেরিকায় পা রাখলেই সেখানে বসবাসকারী ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে তাঁকে ঘিরে যে প্রবল মাতামাতি শুরু হয়ে যায়, এবারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেরিকায় তাঁর প্রথম সফরে নরেন্দ্র মোদী নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় হাজার বিশেক ভারতীয়-আমেরিকান দর্শকের সামনে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ‘ট্র্যাডিশন’ এখনও চলছে।
২০১৯ সালে টেক্সাসে মোদীর ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানেও দর্শক উপচে পড়েছিল, এসেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।
বস্তুত শুধু আমেরিকা নয় পৃথিবীর যে সব দেশে একটা বড় সংখ্যায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকজন বা ‘ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরা’ আছে, সেখানে সফরে গেলেই তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা কিংবা সভায় ভাষণ দেওয়াটা মোদী প্রায় নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন।
আমেরিকা ছাড়াও ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, এমন কী সংযুক্ত আরব আমিরাত গত ন’বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তেই এই একই দৃশ্য দেখা গেছে।
গত মাসে যেমন সিডনির কুদোস ব্যাঙ্ক এরিনাতে মোদীর সভায় প্রবাসী ভারতীয়দের ঢল দেখে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ বলেই ফেলেছিলেন, “এতো রক কনসার্টকেও হার মানাবে!”
কিন্তু ঠিক কীসের আকর্ষণে প্রবাসী ভারতীয়রাও বছরের পর বছর ধরে এভাবে নরেন্দ্র মোদীতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছেন?
বস্তুত মোদীর আগেও ভারতে বহু জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, কিন্তু বিদেশের মাটিতে তারা এরকম আবেগ-উচ্ছ্বাসের ঝড় তুলতে পারেননি যা নরেন্দ্র মোদী করে দেখাচ্ছেন।
বিজেপি ও আরএসএসের প্রভাবশালী নেতা রাম মাধবের মতে, প্রবাসী ভারতীয়দের কাজে লাগিয়ে বিদেশের মাটিতে ভারতের স্বার্থ দেখার জন্য খুব সচেতনভাবে নরেন্দ্র মোদী সরকার তাদের কূটনীতিতে এই ‘ডায়াসপোরা’ এলিমেন্টটা নিয়ে এসেছে।
২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন সবে তাঁর এই ‘ডায়াসপোরা আউটরিচ’টা শুরু করেছিলেন, সে সময় দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে রাম মাধব বলেন, “এই প্রবাসী ভারতীয়রা যে যে দেশে আছেন সে সেব দেশের অনুগত নাগরিক হয়েও কিন্তু ভারতের কন্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেন।”
তিনি আরও বলেছিলেন, আমেরিকার মাটিতে ইহুদীরা যেভাবে ইসরায়েলের স্বার্থ দেখে থাকেন, ঠিক সেভাবেই যাতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও সে দেশে ভারতের স্বার্থ দেখতে পারেন, এটাই ছিল এই পদক্ষেপের পেছনে প্রধান লক্ষ্য।
এই সচেতন প্রচেষ্টা শুরু করার প্রায় এক দশক পর এসে দেখা যাচ্ছে সেই লক্ষ্য অনেকটাই সফল হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর জীবনীকার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রবাসীদের আরও কাছাকাছি পৌঁছতে ২০১৪ সাল থেকে মোদী আর একটি পুরনো পরম্পরাও কিন্তু ভেঙে ফেলেন।
“আগে বিদেশে গিয়ে ভারতের নেতারা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন না, আর সেটাই ছিল রেওয়াজ।”
“কিন্তু ২০১৪র পর থেকে মোদী একের পর দেশে গিয়ে বলতে শুরু করেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে কী কী বদলেছে, কেন ভারতীয় বলে নিজের পরিচয় দিতে মানুষ এখন গর্ববোধ করে, কীভাবে কংগ্রেস ভারতের আত্মমর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করে রেখেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি”, বলছিলেন মি মুখোপাধ্যায়।
এর সঙ্গে যোগ করা হয় প্রচ্ছন্ন হিন্দুত্বের একটা ন্যারেটিভ। নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বিলেত-আমেরিকায় গিয়ে নরেন্দ্র মোদী কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন না, লক্ষ্য করে দেখবেন তিনি কথা বলেন ‘হিন্দু-হৃদয়-সম্রাট’ হিসেবে।”
এর পাশাপাশি, ‘ওভারিসজ ফ্রেন্ডস অব বিজেপি’ নামে বিভিন্ন দেশে ভারতের শাসক দলের সমর্থকদের যে সংগঠন রয়েছে, তারাও লোকবল ও অর্থবল দিয়ে এই প্রচেষ্টায় সক্রিয় সহযোগিতা করেছে।
মোদী সরকারের ‘ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি’র এই ফর্মুলা বহু দেশে দারুণ কাজে দিয়েছে বলেই এখন দেখা যাচ্ছে।
বিরোধী নেতা, কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী পর্যন্ত মোদীর বানানো নিয়মেই এখন খেলতে বাধ্য হচ্ছেন বিদেশ সফরে গিয়ে তিনিও আজকাল নিয়ম করে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে টানার চেষ্টা করেন।
প্রবাসীদের কী প্রাপ্তি?
দিল্লির দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় কলামনিস্ট সৈয়দ জাফর ইসলাম এদিন একটি নিবন্ধে লিখেছেন, মার্কিন সমাজ ‘ক্যুইড প্রো কো’-তে বিশ্বাস করে, অর্থাৎ কিছু দিলে তার বিনিময়ে তাদের কিছু পাওয়ারও আশা থাকে।
তিনি যুক্তি দিয়েছেন, আমেরিকা-প্রবাসী ভারতীয়রাও নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে কিছু পাচ্ছেন বলেই তারা এভাবে সোৎসাহে তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
“আর নরেন্দ্র মোদীও এটা বোঝেন বলেই ভারতীয়-আমেরিকানদের ও অন্য বিনিয়োগকারীদের তিনি ভারতে বিরাট সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন।
তবে শুধু ফেলে আসা দেশে আর্থিক সুযোগ-সুবিধাই নয়, মোদীর সঙ্গে প্রবাসী ভারতীয়দের এই ‘কানেক্টে’র পেছনে একটা গভীর অবেগ ও দেশপ্রেমের জায়গাও অবশ্যই আছে।
দিল্লির সাউথ এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক মনিকা ভার্মার কথায়, “এই ভারতীয় ডায়াসপোরা আসলে উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব আর অ্যাসপিরেশনাল ইন্ডিয়ার মধ্যে একটা ব্রিজ বা সেতুবন্ধনের কাজ করছেন।”
তিনি আরও বলছিলেন, “নরেন্দ্র মোদী খুব ভাল করে জানেন প্রবাসী ভারতীয়রা ‘ইন্ডিয়া স্টোরি’তে ভরসা রাখেন এবং তারা এই নতুন ভারতের জয়যাত্রায় শরিকও হতে চান। আর সেই আকাঙ্ক্ষাটাকেই তিনি খুব ভালভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।”
প্রবাসীদের এই অনুভূতিটা যে যথার্থ, তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ইউএস-ইন্ডিয়া পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান সঞ্জয় পুরীরও।
মি. পুরী বিবিসিকে বলছিলেন, “ভারতীয়ত্ব নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে গর্ব বাড়ছে। মোদীর নেতৃত্বে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন দেখে তারা নিজেদের হোমল্যান্ড নিয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধছেন।”
অথচ মোদী সরকার আজও প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়নি (সীমিত নাগরিকত্ব দিয়েছিল বিগত মনমোহন সিং সরকার), এমন কী ভারতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারও নেই। তারপরও যে মোদী বলতে প্রবাসীরা অজ্ঞান, তার মূল কারণ সম্ভবত ওই ‘ইন্ডিয়া স্টোরি’ই!
শুধু কি গুজরাটিরাই?
২০১৪-১৫ সাল নাগাদ বিদেশে নরেন্দ্র মোদী যে সব জনসভা করেছেন, সেখানে উপস্থিত ভারতীয়দের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন গুজরাটি।
“গুজরাটি অস্মিতার কার্ডটা সেখানে ভীষণভাবে কাজ করত। সব অপপ্রচার রুখে দিয়ে একজন গুজরাটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আমাদের গিয়ে তাঁকে সমর্থন জানানো উচিত, ওই কমিউনিটির ভেতরে এই ভাবনাটা খুব কাজ করত”, বিবিসিকে বলছিলেন নিউ জার্সির বাসিন্দা শৌনক হালদার।
তা ছাড়া যেহেতু গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বহু বছর মোদীকে আমেরিকা ভিসা দেয়নি, তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যখন মার্কিন ভিসা পেলেন তখন আমেরিকায় তাঁর সভায় গিয়ে গুজরাটিরা একটা পাশে থাকার বার্তাও দিতে চেয়েছিলেন।
প্রায় এক দশক পর এখন আমেরিকায় দেখা যাচ্ছে, গুজরাটিরা তো যাচ্ছেনই, তামিলনাডু-মহারাষ্ট্র-অন্ধ্র-তেলেঙ্গানা-পশ্চিমবঙ্গর মতো ভারতের আরও বহু রাজ্য থেকে আসা প্রবাসীরাও এখন দলে দলে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
প্রবাসীদের মধ্যেও গুজরাটের গন্ডী পেরিয়ে মোদীর গ্রহণযোগ্যতা যে একটা ‘সর্বভারতীয়’ মাত্রা পেয়েছে তাতে তাই কোনও সন্দেহ নেই।
তবে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা ও পেশায় চিকিৎসক বিশ্বজিৎ মজুমদার এই বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী ভারতীয়রা সবাই যে নরেন্দ্র মোদীর অন্ধ সমর্থক এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
ড: মজুমদার কলকাতাতে ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “আসলে প্রবাসীদের একটা সাইলেন্ট মেজরিটি ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। অনেকেই আবার হয়তো মোদী সরকারের ওপর তিতিবরক্ত।”
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন বিলেতে বা আমেরিকায় আসেন – তখন এঁরা কেউই পকেটের পয়সা খরচ করে তাঁর অনুষ্ঠানের টিকিট কাটতে যান না, কিংবা কালো পতাকা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভও দেখাতে যান না।
ফলে রোনাল্ড রেগান সেন্টারে কিংবা লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার সেন্ট্রাল হলে যারা নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য শুনতে যান – তারাই প্রবাসী ভারতীয়দের একমাত্র প্রতিনিধি নন বলে বিশ্বজিৎ মজুমদারের অভিমত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
Related News

ভারতীয়দের ভিসার আবেদন গণহারে বাতিল করছে আমিরাত
ভারতীয়দের ভিসার আবেদন গণহারে বাতিল করছে আমিরাত দুবাই ভ্রমণের পরিকল্পনাকারী ভারতীয় পর্যটকদের জন্য সংযুক্ত আরবRead More

ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪০,৫০০ ছাড়িয়েছে
ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪০,৫০০ ছাড়িয়েছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বর্বর হামলায় আরও অর্ধশতাধিকRead More