ইউক্রেন সংকট: দুই পক্ষের চাপে বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক:
ইউক্রেন সংকটে বাংলাদেশকে পাশে চাচ্ছে দুই পক্ষই। ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দার ভি মান্টিটস্কি বলেছেন, বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকুক। আর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছেন, ইউক্রেন সংকটে বাংলাদেশকে পাশে চায় ইইউ।
অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে। বাংলাদেশ চায় আলোচনার মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার- উভয় পক্ষ থেকেই এক ধরনের চাপের মধ্যে আছে ঢাকা। এ অবস্থায় নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হলে বাংলাদেশকে আরও কৌশলী হতে হবে। বাংলাদেশের উচিত হবে, উভয় পক্ষকে জাতিসংঘ সনদ, জেনেভা সনদ ও মানবাধিকার সনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানানো।
একাধিক কূটনীতিক সমকালকে জানান, ইউক্রেন সংকট ঘিরে বিশ্বরাজনীতিতে একটা মাত্রাগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর হাতে বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক জোট ন্যাটো আছে। তারা দৃশ্যত রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ায়নি। বরং পরিস্থিতিটা এমন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা ইউক্রেনে রাশিয়ার আরও বর্বরতার ছবি ও ভিডিওচিত্রের জন্য অপেক্ষা করছে। যে চিত্র দেখিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ প্রয়োজনে চূড়ান্ত সামরিক হামলার পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করতে পারে।
একজন কূটনীতিক বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন ইস্যুতে ভোটাভুটিতে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে ভোটদানে বিরত ছিল চীন ও ভারত। তারা সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেয়নি। চীনের ভেটো ক্ষমতা থাকলেও চীন সে ক্ষমতা রাশিয়ার সমর্থনে প্রয়োগ করেনি। এর অর্থ দাঁড়ায়, চীন এখনই সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়াতে চাচ্ছে না। ভারতও তাদের এখনকার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সমর্থন করতে চাচ্ছে না। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতও ভোটদানে বিরত থেকেছে। তাদের অবস্থানও ভারতের অবস্থানের সমার্থক। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির এ চিত্রই ইউক্রেনে রাশিয়ার আরও ভয়াবহ হামলা এবং ন্যাটোর দ্রুত প্রত্যাঘাত ঠেকিয়েছে। কারণ ভোটাভুটির এই চিত্র রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই কিছুটা হলেও অস্বস্তির কারণ। এর ফলে রাশিয়া ইউক্রেনে বিধ্বংসী হামলার পরিবর্তে জানমালের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হামলার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতি নিয়েছে। এ নীতি থেকে তারা ইউক্রেনকে আলোচনারও প্রস্তাব দিয়েছে।
তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাঘাতের ক্ষেত্রে আগে জনমত তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। আরও কয়েক দিন পর বিশ্বরাজনীতির চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে যাবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কারোরই ঘনিষ্ঠ মিত্রদের এই কৌশলগত দূরে থাকার নীতি খুব বেশি দিন থাকবে না। পরিস্থিতি বেশি জটিল হলে মিত্রদের অবস্থান স্পষ্ট করতেই হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সফল আলোচনাই কেবল পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হওয়া ঠেকাতে পারে।
অপর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এখন বিশ্বরাজনীতির পরিস্থিতি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিকর। চীন ও ভারত সরাসরি কারও পক্ষে না যাওয়ার কারণে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে পারছে। যদি চীন সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চলে যেত, তাহলে বাংলাদেশের সামনে বড় একটা কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ চলে আসত। তখন ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থায় পড়তে হতো বাংলাদেশকে। তবে সে অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বাংলাদেশের সামনে ইউক্রেন পরিস্থিতি বড় হয়ে উদ্বেগের কারণ হয়েই থেকে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহায়তা দানকারী। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর বাণিজ্য ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৮৪ ডলার। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে রাশিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। একদিকে তৈরি পোশাকের রপ্তানির বাজারে প্রভাব পড়লে বাংলাদেশকে যেমন সংকটে পড়তে হবে, অন্যদিকে মেগা প্রকল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেও সংকটের সৃষ্টি করবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এবং বিদেশের শ্রমবাজার অস্থিতিশীল হলে সেটাও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আরও কিছুদিন উদ্বেগ ও অস্বস্তির মধ্যেই থাকতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অবশ্যই নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানেই থাকবে। একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং সে হিসেবে একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকা দরকার। এ কারণে বাংলাদেশের আর একটু কৌশলী হয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের প্রতি জাতিসংঘ সনদ, জেনেভা সনদ এবং মানবাধিকার সদনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানানো উচিত। কারণ এসব সনদ অনুযায়ী একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে গায়ের জোরে হামলা চালানো যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকেই সাম্প্রতিক বছরগুলোর ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ইউক্রেন সরকারের এক দশকের ভ্রান্ত নীতির জন্য। কারণ রাশিয়ার মতো একটি শক্তিধর দেশ তার প্রতিবেশীকে কোনোভাবেই ন্যাটো জোটে দেখতে চাইতে পারে না। সেটা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই হুমকি মাথায় নিয়ে রাশিয়ার মতো দেশ চুপ থাকতে পারে না। ইউক্রেনের রুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি প্রদেশেও ইউক্রেন বারবার হামলা করেছে এবং এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছে। তারপরও কোনোভাবেই সামরিক হস্তক্ষেপ, প্রাণহানি কাম্য নয়। এ কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী কোনো পক্ষেই অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না। আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানকেই সমর্থন করতে হবে। সূত্র : সমকাল
Related News
কুয়েত থেকে লাশ হয়ে ফিরল শালা-দুলাভাইের নিথর দেহ
কুয়েত থেকে লাশ হয়ে ফিরল শালা-দুলাভাইের নিথর দেহ আরব উপদ্বীপের দেশ কুয়েত থেকে কফিনে করেRead More
যুক্তরাজ্যে ঘূর্ণিঝড়ে গাছচাপায় সিলেটির মৃত্যু
যুক্তরাজ্যে ঘূর্ণিঝড়ে গাছচাপায় সিলেটির মৃত্যু যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গাছ উপড়ে পড়ে কাহেরRead More